নারী দিবসের আনুষ্ঠানিক যাত্রাটা শুরু হয়েছিল ১৯৭৫ সালে। প্রকৃত পক্ষে নারী দিবসের শুরুর প্রেক্ষাপটটা ছিলো নারী শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের নিরন্তর সংগ্রামের। তখন সেখানে মজুরি বৈষম্য ছিল, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট ছিল না, কাজের পরিবেশও ছিল যথেষ্ট অমানবিক। এধরণের অরাজক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে নারী শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভে নেমে পড়ে। ১৮৫৭ সালে আমেরিকার নিউইয়র্কের রাস্তায় নামেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা, প্রতিবাদী মিছিল বের হয়; দমন-নিপীড়নের জন্য সে মিছিলে গুলি চালাতে দ্বিধা করেনি সে সময়কার শাসকগোষ্ঠী। কিন্তু প্রতিবছর নারী অধিকার আদায়ের ও প্রতিষ্ঠার বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটকে বিবেচনা করে জাতিসংঘ এ দিবসটির তাৎপর্য নির্ধারণ করেন। সারা বিশ্ব নির্ধারিত এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই এ দিবসটি উদযাপন করে। এবছর জাতিসংঘ প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে করোনা মহামারিতে নারী নেতৃত্ব এবং ভবিষ্যৎ সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়ার ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে।

নারী দিবসের শুরুর প্রেক্ষাপট ও বর্তমানের প্রেক্ষাপটের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। এখনো নারীর সার্বিক সামাজিক নিরাপত্তা প্রশ্নবিদ্ধ! শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরণের নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কখনো কখনো নারীর প্রতি বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ আমাদের মূল্যবোধকে ধুলিসাৎ করে দিচ্ছে। আমাদের চলমান সমাজ ব্যবস্থা ও দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরুষতান্ত্রিক। যেগুলোর বলয় থেকে নারীর এখনো মুক্তি ঘটেনি। এই অবস্থার অবসানে প্রয়োজন নারী ও পুরুষের সমঅংশগ্রহণ।
যে বিষয়টি উপস্থাপনার অবতারণা করছি সেটি হলো, কখনো কখনো একটি উন্নয়ন প্রকল্প সামগ্রিক অচলাবস্থা বা প্রগতিশীল উদ্যোগ গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ী বিষয় হতে পারে! নারীরা এই সমাজ পরিবর্তনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। তাদের সৃজনশীল ও কর্মতৎপরতায় বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সকল গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক লড়াই-আন্দোলনে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল অসীম অনুপ্রেরণার। বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতেও নারীর এই নেতৃত্ব গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। নারীর ভূমিকা শুধু পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়, বর্তমান কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় নারীর প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব মানুষকে এই ক্রান্তিকাল থেকে উত্তরণের পথ দেখিয়েছে। যা নারী নেতৃত্বের ভূমিকাকে বৈশ্বিকভাবে আরো সুদৃঢ় ও সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩ পার্বত্য জেলায় ‘আওয়ার লাইভস্, আওয়ার হেলথ্, আওয়ার ফিউচারস্’ (ওএলএইচএফ) শীর্ষক প্রকল্পটি পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর ১০ থেকে ২৫ বছর বয়সী কিশোরী ও নারীদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে কাজ করছে। উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামেই বাঙালি ছাড়াও প্রায় ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর বসবাস। এই জনগোষ্ঠীর মানুষগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই জনপদে বসবাস করলেও, তাদের সামগ্রিক জীবনমান এখনো সংকটময় ও নাগরিক সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত। তারা প্রকৃতির উপর নির্ভর করেই তাদের জীবন অতিবাহিত করে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ও সিমাভি নেদারল্যান্ডস্ এবং বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘ (বিএনপিএস)’র সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থানীয় ১০টি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগলিক, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে তাদের নারীর ক্ষমতায়ন, জীবন দক্ষতা বৃদ্ধি এবং নির্যাতন ও স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে সামগ্রিক জীবনমান উন্নয়নে প্রকল্পটি কাজ করছে। প্রকল্পটি ২০১৯ সালে শুরু হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলমান থাকবে।

এ প্রকল্পের আওতায় ১০টি স্থানীয় সংস্থার অধীনে ১৭টি উপজেলায় এই প্রকল্পের কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পের অন্যতম কার্যক্রম হলো কিশোরী ক্লাব পরিচালনা করা। এই প্রকল্পের আওতায় ৩ পার্বত্য জেলায় মোট ৩০০টি কিশোরী ক্লাবের আওতায় প্রায় ১২০০০ কিশোরী ও নারী প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত রয়েছেন। এই কিশোরী ক্লাব পরিচালনার ক্ষেত্রে রয়েছে মাস ভিত্তিক নির্ধারিত পাঠ্যসূচি, যেটি অনুসরণ করে কিশোরী ক্লাবের সেশনগুলো পরিচালিত হয়। এই পাঠ্যক্রমের আওতায় যে বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে সেগুলো হলো, একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে জানা, নিজের জীবনে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং মর্যাদাপূর্ণ জীবন গঠনের ক্ষেত্রে উপাদানগুলো জানা, মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার অধিকারের পাশাপাশি প্রজনন ও যৌন স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং অধিকারগুলো জানা, জীবনের সংকটময় মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়া, বৈষম্য ও নির্যাতনের কারণগুলো জানার মাধ্যমে নির্যাতনমুক্ত থাকার উপায়গুলো সম্পর্কে জানা।

যদিও এটি একটি উন্নয়ন প্রকল্পের অন্তর্গত বিষয়, তবে নারীর পশ্চাৎপদতা কিংবা অনগ্রসরতার অনেক নিগুঢ় বিষয় এই কার্যক্রমের মাধ্যমে আলোকপাত করা হয়েছে। কার্যক্রম বাস্তবায়নেও বিষয়গুলোকে আন্তরিকভাবে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যার ফলে একটি স্থায়িত্বশীল পরিবর্তনে এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। তবে, আমি এখানে একটি প্রকল্পকে ঘিরে যে বিষয়টি প্রাধান্য দিতে চাই, সেটি হলো এর বিস্তৃতি সারাদেশব্যাপিই প্রয়োজন। কারণ, নারীর প্রতি সংহিসতা ও নির্যাতনের সামগ্রিক চিত্র যেকোন বিবেকবান মানুষকেই আতঙ্কিত ও বিষন্ন করে তুলবে।

নারীর প্রতি এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক কুসংস্কারগুলো ভাঙতে হলে, সকলকে মানুষ হিসেবে নারী-পুরুষের সমান মর্যাদাবোধকে আগে স্বীকৃতি দিতে হবে। পরিবার থেকে রাষ্ট্রে নারীর বন্ধুর পথচলায় তৈরি করতে হবে সহায়ক পরিবেশ। যে পরিবেশে নারী নিজের স্বকীয় যোগ্যতার প্রকাশ ও অধিকার ভোগ করার পূর্ণ সুযোগ পাবে। তবেই নারীর অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। পুরুষ ও নারীর যুথবদ্ধতায় এগিয়ে যাবে এই প্রিয় স্বদেশ।
নারী দিবসে সকল সংগ্রামী নারীকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক : সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক।