কিশোরগঞ্জ জেলার মধ্যে কটিয়াদী একটি প্রাচীন সমৃদ্ধ জনপদের নাম। শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির ক্ষেত্রে এক সুপরিচিত নাম। এই জনপদেরই কটিয়াদী উপজেলা সদরের পশ্চিমপাড়াস্থ শ্রী শ্রী মা মহামায়া গাছতলা বেদীটি অত্র এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে এক ধর্মীয় পবিত্র স্থান।
সর্বোপরি অত্র এলাকার মানুষের কাছে এই স্থানটি ঐতিহ্যবাহী পূণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তবে সাধারণত ধর্মীয় যে কোন স্থানের ঐতিহ্য বা গুরুত্বের পেছনে একটা আধ্যাত্বিক ইতিহাস জড়িয়ে থাকে।
এই স্থানটির প্রেক্ষাপটটির পেছনেও এমন একটি প্রচলিত ঘটনার কথা লোক মুখে প্রায়ই শোনা যায়। তবে এলাকার প্রবীণদের মতে, এই মহামায়া গাছতলার বটবৃক্ষটির বয়স প্রায় দুইশত বছরেরও অধিক।
তবে এই স্থানের ইতিহাস নিয়ে কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য ভিত্তিক লিখিত প্রকাশনা বা গবেষণা না থাকলেও, এটি এখন শ্রীশ্রী মা মহামায়া মায়ের পূজার জন্য সর্বজনীন অনুষ্ঠান স্থল হিসেবেই পরিগণিত হয়ে আসছে।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস মতে, এই বৃক্ষের মাঝে আদ্যাশক্তি মা মহামায়া অধিষ্ঠিত আছেন। সেই বিশ্বাস ও ভক্তি থেকেই এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ এখানে প্রতি বছরের ১লা বৈশাখে (পঞ্জিকা মতে) শ্রীশ্রী মা মহামায়ার পূজা, বলিদান ও নানা পণ্যের পসরা নিয়ে মেলা বসে এবং অমাবস্যা –পূর্ণিমা তিথিতে প্রদীপ প্রজ্বলন ও নানা পূজার আয়োজন করে থাকে।
সারা বছরই নানা আয়োজনে ও উপাচারে মহামায়া মায়ের পূজা-অর্চনা অনুষ্ঠিত হলেও, বাংলা নববর্ষে নতুন সাজে সজ্জিত হয় শ্রী শ্রী মহামায়া গাছতলা। এই অনুষ্ঠানটি সর্ববৃহৎ আকারে উদযাপিত হয়। এ পূজা উপলক্ষ্যে এলাকায় উৎসবের আমেজ বিরাজ করে।
নানা রংয়ের ও ধরণের জিনিসের পসরা নিয়ে মেলা বসে। এলাকার অনেকের কাছের করোনাকালে মহামায়া গাছতলা পূজার এই স্মৃতি বড্ড অপ্রত্যাশিত। কারণ অনেকেই এই একটি দিনের আশায় সারা বছর প্রহর গুণে থাকে।

এবারের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে অনেক মানুষের মানসিক প্রস্তুতি থাকলেও লকডাউনের কারণে গাছতলা প্রাঙ্গণে থাকবে নীরবতা। পূজা ও মেলা বসছে না বলে, ছোট-বড় অনেকেরই মুখ মলিন।
মেলা প্রাঙ্গণেই শুধু এ মেলার বিস্তার নয়। মেলা উপলক্ষে অনেকেই এলাকার জামাই আর আত্মীয়স্বজনকে আমন্ত্রণ জানায়। তাই বাড়িতে বাড়িতে খই, মুড়কি, নারকেল আর দুধের নাড়ু বানানো হয়। মেলা থেকে নানা জিনিস কিনে নেওয়া বা খাওয়ার রেওয়াজটিও এখনো ধরে রেখেছেন এলাকাবাসী।
স্থানীয় অনেকেই বিয়ের পর নববধূকে বাড়িতে নিয়ে উঠার আগে শ্রীশ্রী মা মহামায়া কে প্রণাম করে তারপর বাড়িতে নববধূকে নিয়ে উঠেন। অনেক ক্ষেত্রে ছোট শিশুদের অন্নপ্রাশনের আনুষ্ঠানিকতা পালনও এই বেদী তলায় হয়ে থাকে।
কিন্তু গত দুই বছর যাবত করোনা সংক্রমণরোধে সরকার ঘোষিত নিষেধাজ্ঞার কারণে শুধুমাত্র অনানুষ্ঠানিক শাস্ত্রীয় উপাচারে মা মহামায়ার পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই মহামায়া গাছতলা বা বেদীতে স্থানীয় অনেকেই নিত্য পূজা করে থাকে। সেই সাথে কটিয়াদীসহ আশেপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকেও এই বেদীতে পুণ্যার্থীদের নিয়মিত আসতে দেখা যায়। শুধু ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য নয়, এই এলাকার অগণিত নবীন-প্রবীণের মনে এই বেদীকে ঘিরে রয়েছে, অনেক মধুর স্মৃতি।
নিয়মিত পূজা পার্বণের মধ্য দিয়ে এবং এই নববর্ষে সীমিত আকারে শাস্ত্রীয় উপাচারের মাধ্যমে দেশ ও দশের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনার পাশাপাশি করোনা ভাইরাসে সৃষ্ট মহামারি থেকে মুক্তির প্রার্থনা জানানোর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের শ্রীশ্রী মা মহামায়া মায়ের পূজা।
লেখক : সুমিত বণিক, জনস্বাস্থ্যকর্মী ও প্রশিক্ষক ।