বিশ্ব মাসিক স্বাস্থ্য দিবস নিয়ে এবছরের প্রতিপাদ্য দেখে, আমি যা বুঝলাম তা হলো-মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আরো কি কি কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এবং মাসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিনিয়োগ করা। মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রায় অনেক বছর ধরেই কাজ করেছি এবং বর্তমানেও পার্বত্য চট্টগ্রামে এলাকায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ওএলএইচএফ প্রকল্পে এই বিষয় নিয়ে কাজ করছি। এবারের মাসিক স্বাস্থ্য দিবসের আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগ হিসেবে, আমি মাসিক চলাকালীন সময়ে ব্যবহার্য উপকরণসমূহ সবার সুবিধার্থে এমন একটি জায়গায় রাখবো যেখানে যে কেউ চাইলেই নিয়ে ব্যবহার করতে পারবে এবং এর পাশাপাশি এই বিষয়টির সাথে আমার ৫ বছর পূর্ণ হওয়া ছেলে বাচ্চার সাথেও অল্প অল্প করে পরিচিতি করাবো। কারণ মাসিক নিয়ে কিশোরীদের পাশাপাশি কিশোরদের মধ্যেও রয়েছে নানা কৌতুহল। ছোটকাল থেকে যদি এসব বিষয়ে তাদের সঠিক ধারণা দেওয়া হয়, তবে তাদের মধ্যেও সহযোগীতামূলক মনোভাবের সৃষ্টি হবে বলে বিশ্বাস করি।
আমরা এখন এমন একটি যুগে বসবাস করছি যেখানে সকল প্রকার তথ্য হাতের নাগালেই। প্রযুক্তির কল্যাণে এক ক্লিকেই সব তথ্য সামনে এসে হাজির হয়। কিন্তু এই প্রযুক্তির যুগেও বসবাস করেও স্বাস্থ্য পরিচর্যার ক্ষেত্রে আমরা বিভিন্ন প্রকার ভুল তথ্য অনুসরণ করি এবং বদ্ধমুল ধারণাকে লালন করি। বিশেষ করে মাসিকের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্বাভাবিক বিষয়ে আমাদের জ্ঞান অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানসম্মত নয়। মাসিক সম্পর্কে পরিবারের সদস্যদের ভুল ধারণা, নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করে না দেওয়া (মায়েদের জন্য মাসিকের কাপড় পরিবর্তন করা বা কাপড় ধোয়ার জন্য গোপনীয় এবং নিরাপদ স্থান) এবং উদাসীনতা কিশোরী মেয়েদের মাসিক চলাকালীন সময়ে মাসিক ব্যাবস্থাপনা করার বিষয়টিকে অনেক ক্ষেত্রে কঠিন করে দেয়।
পরিবার থেকেই খাবারের ব্যাপারে বাধা, চলাফেরার ব্যাপারে নিয়ম শৃঙ্খলা তৈরি করে দেওয়া মেয়েদের নিত্যদিনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার মানকে ব্যাহত করে। তিন পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এর চিত্র আরো নাজুক। এখানের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর প্রচলিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক রীতি-নীতি, ভুল বিশ্বাস, সচেতনতার অভাবে অপরিস্কার কাপড় ব্যবহার এবং ব্যবহৃত কড়া রোদে না শুকিয়ে ময়লাযুক্ত স্থানে ফেলে রাখা, স্বাস্থ্য শিক্ষার অভাব, ভৌগোলিক অবস্থা এবং বৈদ্য কবিরাজদের উপর নির্ভরশীলতা মাসিক সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাবার পথকে অনেকটাই সংকুচিত করে দিচ্ছে। এখনো বিভিন্ন কমিউনিটির মানুষ মনে করে মাসিক একটি রোগ, এটি নিছক মেয়েলী ব্যাপার এবং মাসিক নিয়ে খোলামেলা আলোচনা তরুণ সমাজকে নষ্ট করে দিবে ইত্যাদি। কিন্তু বাবা-মায়েরা যদি এসব বিষয় নিয়ে ছেলে মেয়েদের সাথে আলোচনা করে, তবেই সমাজে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করা সম্ভব। সেই সাথে যে সকল মেয়ে মাসিক সম্পর্কিত ভুল ব্যবহারের কারণে যারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, তারা এসব রোগ থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পাবে। আর এই ক্ষেত্রে মায়েদের পাশাপাশি বাবা, ভাই এবং পরিবারের অন্যান্য পুরুষ সদস্যরা বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখতে পারে। তাই
মা দিবস, বাবা দিবস, পরিবেশ দিবসের মতো আড়ম্বরপূর্ণ করে না হলেও কাছের মানুষ, বন্ধুসহ সবার সাথে মাসিক স্বাস্থ্য নিয়ে খোলামেলা আলোচনার প্রথাটা শুরু করাটা জরুরী।
ফলে এটি মেয়েদের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করবে, তারা আত্মবিশ্বাসের সাথে মাসিককালীন সময়টুকু স্বাভাবিকভাবে উপভোগ করতে পারবে, বিভিন্ন প্রকার স্বাস্থ্য ঝুঁকিগুলো হতে মুক্ত থেকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারবে এবং মাসিক নিয়ে গর্ববোধ করবে। তাই আসুন, সবাই মিলে নারীদের মাসিককে সুন্দরভাবে ব্যাবস্থাপনা করার জন্য উৎসাহ প্রদান করি, এটি নিয়ে কথা বলার জন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলি এবং নিজ নিজ অবস্থা থেকে কে কি ভূমিকা পালন করতে পারি, সেই চিন্তা করি।
সেই সাথে মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, নিয়মিত প্রক্রিয়ায় মাসিক হলে একজন মেয়ে সুস্থ সবল থাকে, মেয়েদের শারীরিক জৈবিক প্রক্রিয়াটা স্বাভাবিক থাকে। তাই মাসিক নিয়ে বিব্রত বা লজ্জাবোধ করার কিছু নেই, এটি নারীর জীবনে একটি প্রাকৃতিক জৈবিক প্রক্রিয়া। আসুন, মাসিক সম্পর্কিত সঠিক তথ্যগুলো সবার সাথে বিনিময় করি এবং সুস্থ্য থাকি।
লেখক : রিমি চাকমা, উন্নয়নকর্মী ও প্রশিক্ষক ।
(বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কর্মরত)